"এল ডোরাডো"

সোনার শহর অথবা সোনায় মোড়া শহর শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথম যে নাম টা ঘুরপাক খায় সেটা হলো এল ডোরাডো (El Dorado)।

এল ডোরাডো শব্দের অর্থ হলো "স্বর্ণের তৈরি"। এল ডোরাডো শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ ভাষা "এল হাম্রে ডোরাডো" থেকে যার অর্থ সোনার মানুষ

প্রাচীন যুগ থেকেই লোকমুখে অনেক প্রকারের কাল্পনিক জনপদের অস্তিত্ব গড়ে উঠেছিলো, তার মধ্যে এল ডোরাডো অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত এই জনপদের অস্তিত্ব সন্ধান প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বহু মানুষের। এক সময়ে গুজবের উপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের মধ্যে এল ডোরাডো নিয়ে একপ্রকারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
কলম্বাসের পথ ধরে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদীরা দক্ষিণ আমেরিকায় তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে তখন বিনিময় প্রথার প্রচলন ছিলো। বিনিময় প্রথায় অভ্যস্ততার কারণে আদিবাসীদের কাছে সোনা, রুপো, প্লাটিনামের মতো ধাতু খুব বেশি মূল্যবান বলে গণ্য হতো না। বরং এগুলোর উজ্জ্বলতার কারণে এগুলো দিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণ এবং অলংকার তৈরীতে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু পুঁজিবাদী হানাদাররা সোনার অলংকার পড়া আদিবাসীদের দেখে ভেবেছিলেন এইসব আদিবাসীদের সন্ধানে স্বর্ণের কোনো বিশাল খনি রয়েছে।

স্বর্ণের বিশাল বিশাল ভাস্কর্যের সাথে সোনার অলংকার পরিহিত আদিবাসী ছাড়াও এই আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত একটি প্রথাও ইউরোপীয়দের মনে এল ডোরাডো সম্পর্কে বিশ্বাসকে মজবুত করেছিলো।
খ্রিস্টাব্দ ত্রয়োদশ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর পশ্চিম প্রান্তে মুসাইকা নামক একটি সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিলো। এই মুসাইকা সভ্যতার জনপদগুলি একটি রাজার অধীনে পরিচালিত হতো। একটু ভিন্ন নিয়মে রাজার বোনের বড়ো ছেলে পরবর্তী রাজা হতেন। রাজ্যাভিষেক এর রীতি হিসাবে নতুন রাজার পুরো শরীরে স্বর্ণের গুঁড়ো মাখানো হতো এরপর তার অভিষেক করার জন্য রাজা কে নিয়ে যাওয়া হতো স্থানীয় একটি হ্রদে। সেখানে তিনি চন্দ্রদেবীর উদ্দেশ্যে স্বর্ণের তৈরী অলংকার এবং স্বর্ণের তৈরী সামগ্রী জলে বিসর্জন দিতেন। এই রীতির দ্বারা চন্দ্রদেবীর উদ্দেশ্যে দেওয়া রাজার ত্যাগ কে উপস্থাপন করতো।
স্প্যানিশ লেখক Juan Rodriguez Freyle এর লেখায় প্রথম এই রীতির বিবরণ পাওয়া যায়।

লেক গুয়াটাভিটা নামক ওই হ্রদে স্বর্ণ উদ্ধারের কাজে কয়েক দফা প্রচেষ্টা চালায় ইউরোপের পরাশক্তি কয়েকটি সাম্রাজ্য।
ইতিহাসে প্রথম এল ডোরাডোর উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫৩১ সালে। পূর্ব ভেনেজুয়েলার পারিদিয়া উপদ্বীপ এলাকার গভর্নর ডিয়াগো ড‍্যাউরদ্যাস অভিযান চালাতে গিয়ে তার বাহিনীর হাতে কিছু আদিবাসী আটক হয় এবং সেখানেই ডিয়াগো ড‍্যাউরদ্যাস প্রথম একটি ঐশ্বর্যময় জনপদের বর্ণনা শুনেছিলেন।
কিন্তু পরবর্তীতে বিষক্রিয়ায় ডিয়াগো ড‍্যাউরদ্যাসের মৃত্যু হয়।

বর্তমানে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা থেকে প্রায় ৫৭ কিমি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত লেক গুয়াটাভিটা প্রায় ১২৫ মিটার মতো গভীর এবং ৫০ একর জায়গার উপর অবস্থিত।

তৎকালীন আদিবাসীদের সময় এটা পবিত্র তীর্থস্থানরূপে গণিত হতো, কিন্তু ১৯৬৫ সালে কলম্বিয়ার সরকার লেক গুয়াটাভিটাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষিত করেছে।

সংরক্ষিত এলাকা ঘোষিত হওয়ার আগে মোট দুইবার লেক গুয়াটাভিটার জল সেচে সোনা উদ্ধারের কাজ হয়। দুইবারের প্রচেষ্টায় সেখান থেকে কিছু পরিমান সোনাও উদ্ধার করা হয়। যার বর্তমান বাজার মূল্য পাঁচ কোটি টাকার কাছাকাছি।

পরবর্তীতে আমব্রুফিয়াস ডালফিঙ্গার, গঞ্জালো পিজারো, গঞ্জালেস ডোমিনিস ডিকুইসিডা, ফিলিপ হন হুটেনের মতো বিভিন্ন অভিযাত্রীরাও এল ডোরাডোর সন্ধানে নিজেদের জীবনের কয়েক বছর করে সময় ব্যায় করেছেন।

এইভাবেই কাল্পনিক জগতের এল ডোরাডো মানুষের মনে বাস্তবের দাগ টেনে দিয়ে গিয়েছে।

Read The Article in English "El Dorado"

পূর্বের পোস্ট:- THE MODESTY MESMERIZES BUT ARROGANCE EXASPERATES

Comments

Post a Comment

Popular Posts