"হারকিউলিস"


একদিকে শক্তি ও সাহস অপর দিকে দয়ালু ও বুদ্ধিমান। এই চারটি গুন সম্পন্ন কোনো ব্যক্তিকে নিঃসন্দেহে বীরের সন্মান দেওয়াই যায়।
হ্যাঁ বলছিলাম গ্রীক ও রোমানদের অন্যতম পৌরাণিক দেবতা হারকিউলিস (HERCULES) এর কথা।

গ্রীক ও রোমান পুরান অনুযায়ী হারকিউলিসকে সর্বশ্রেষ্ঠ বীরের মর্যাদাও দেওয়া হয়েছে।

হারকিউলিসই গ্রীক বা রোমান পুরাণের একমাত্র দেবতা যে কিনা একজন মানুষ নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

ঘটনার সূত্রপাত হয়, যখন গ্রীক দেবতা জিউস (ZEUS) আল্কামিনি (ALCMENE) নামক একজন নারী কে ভালোবেসে ফেলেন। আল্কামিনির স্বামী আমফ্রিটিয়ন (AMPHITRYON) যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য গেলে সেই সুযোগে জিউস আল্কামিনির স্বামী আমফ্রিটিয়নের রূপ ধরে এসে শারীরিক সম্পর্ক করেন।
এর ফলে আল্কামিনি গর্ভবতী হলে তিনি দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।
প্রথম সন্তানের নাম হেরাক্লেস (HERACLES) দ্বিতীয় সন্তানের নাম ইফিসিলিস (IPHICLES)।

জিউসের প্রথম স্ত্রী হেরা (HERA) যখন এই খবর জানতে পারেন যে হেরাক্লেস এবং ইফিসিলিস জিউসের অবৈধ সন্তান তখন তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে দুই জন শিশুকে হত্যা করার জন্য দুটি বিষাক্ত সাপ পাঠান।
যদিও উল্লেখ্য যে আল্কামিনি তার প্রথম সন্তানের নাম হেরাক্লেস রেখেছিলেন গ্রীকদের প্রধান দেবী হেরাকে সন্তুস্ট করার জন্যই। "হেরাক্লেস" শব্দের অর্থ হলো "হেরার গর্ভ" অথবা অনেকে English এ একে "Glory of Hera" ও বলে থাকেন। হারকিউলিস দুটি সাপকেই নিজ হাতে হত্যা করে ফেলেন।
নিজের শক্তি সমন্ধে হারকিউলিসের কোনো ধারণা ছিলো না। তাই বহুবারই তিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন।
যেমন ছোটোবেলায় তিনি তাঁর সংগীত শিক্ষকের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে বীণা দিয়ে মাথায় আঘাত করে তাঁর সংগীত শিক্ষককে হত্যা করে ফেলেন। এছাড়াও বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো রাজা থাসপিয়াস একবার একটি সিংহকে হত্যা করার জন্য হারকিউলিসকে বলেন। হারকিউলিস একাই সেই ভয়ঙ্কর সিংহকে হত্যা করেন এবং যার পুরস্কার হিসাবে রাজা থাসপিয়াস তার পঞ্চাশটি কন্যা হারকিউলিস কে দান করেন।
এরপর হারকিউলিস থিবেসে (THEBES) মেগারা (MEGARA) নামক একটি মহিলাকে বিবাহ করেন ও তাদের তিনটি সন্তান হয়।

এইসময় হারকিউলিসের প্রভাব, খ্যাতি এবং সফলতা দেখে হেরার মনে ফের হিংসা হয় এবং এবার তিনি হারকিউলিস কে উন্মাদ করে দেন। এই উন্মাদনার বশে তিনি তার তিন সন্তান ও স্ত্রী মেগারা কে হত্যা করেন। দেবী এথেনা (ATHENA) হারকিউলিসকে পাথরের টুকরো ছুড়ে মারলে পরে তিনি এই উন্মাদনা থেকে মুক্তি পান।
সুস্থ হওয়ার পর তিনি এই কর্মকান্ড নিয়ে অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন এবং শেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
এইসময় তার ভাই এসে তাকে থামান এবং পরামর্শ দেন ডেলসি (DELSEA) তে ওড়াকেলের (ORACLE) কাছে যেতে। ওড়াকেলস তাকে ইউরেসথিয়াসের (EURYSTHEUS) কাছে পাঠালে ইউরেসথিয়াস হারকিউলিসকে ১২ টি কঠিন কাজ দেন। এবং বলেন যে ১২ টি কাজ করলে তিনি তার পূর্বের পাপ থেকে মুক্ত হতে পারবেন। এই বারোটি কাজকেই হারকিউলিসের ১২ টি শ্রম বা Twelve Labour of Hercules বলা হয়ে থাকে। তবে প্রথমেই যেমনটা বলেছি হারকিউলিস হলেন গ্রীক ও রোমান পুরাণের একটি চরিত্র তাই হারকিউলিস কে নিয়ে মতভেদও আছে। যেমন অনেক মতভেদ অনুযায়ী মানুষ থেকে দেবতার আসন পাওয়ার জন্য হারকিউলিসকে এই ১২ টি পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। আবার ভিন্ন মত অনুযায়ী হারকিউলিস নিজেকে স্ত্রী ও সন্তানের হত্যার পাপ থেকে মুক্ত করতে ইউরেসথিয়াসের দাস হয়ে ১২ বছর কাটিয়েছিলেন এবং এই বারোটি কঠিন কাজ তাকে ইউরেসথিয়াস দিয়েছিলেন করার জন্য।
এই বারোটি শ্রম হলো:-

প্রথম, দুর্ভেদ্য চামড়ার অধিকারী নেমিয়ান (NEMEAN) সিংহের সাথে লড়াই করে তাকে পরাজিত করা।
দ্বিতীয়, নয় মাথা বিশিষ্ট হাইড্রাকে (HYDRA) পরাজিত করা।
তৃতীয়, দেবী ডায়নার (DYANA) পোষ্য হরিণকে নিয়ে আসা।
চতুর্থ, জঙ্গলের দানবীয় এক শুকরকে বধ করা।
পঞ্চম, ত্রিশ হাজার বছর ধরে অপরিস্কার  বিশাল এক আস্তাবলকে একদিনে পরিষ্কার করা।
ষষ্ঠ, স্টীম্ফ‍্যালিয়ান (STYMPHALIAN) ঘাতক পাখিদের হত্যা করা।
সপ্তম, শক্তিশালী ক্রেটান (CRETAN) ষাড়কে বধ করা।
অষ্টম, ডায়োমেডিসের (DIOMEDES) তিনটি শিকারী ঘোড়াকে বশ্যতা স্বীকার করানো।
নবম, হিপোল্যাটারের (HYPPOLYTA) কোমরবন্ধনী নিয়ে আসা।
দশম, গেরিয়ানের (GERYON) অপ্রতিরোধ্য গোষ্ঠীকে হারানো।
একাদশ, জিউসহেরার বিবাহের উপহার হিসাবে পাওয়া তিনটি স্বর্ণ আপেল চুরি।
দ্বাদশ, তিনমাথা বিশিষ্ট কুকুর পাতালপুরীর দরজার রক্ষক সারবেরাস (CREBERUS) কে বন্ধী বানানো।
বারোটি কাজ সম্পূর্ন হয়ে যাওয়ার পর তিনি ডায়ানিরা (DEIANIRA) নামক একজন নারীকে বিবাহ করেন। সদ্য বিবাহিত ডায়ানিরা নিয়ে নিজের বাড়ি ফেরার পথে পরে যায় খরস্রোতা একটি নদী। এইসময়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন এক স্যান্টাউর নেসসুস (NESSUS)।

হঠাৎ করেই নদী পার করানোর উদ্দেশ্যে স্যান্টাউর নেসসুস ডায়ানিরাকে ধর্ষণ করার জন্য উদ্যত হন। হারকিউলিস তা বুঝতে পেরে স্যান্টাউর কে বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করেন।
মৃত্যুর আগে স্যান্টাউর ডায়ানিরাকে তার পোশাকটি দিয়ে দেন এবং বলেন কখনো যদি ডায়ানিরার মনে হয় যে তার স্বামী তাকে আর আগের মতো ভালোবাসছে না, তবে এই পোশাকটি তাকে পড়িয়ে দিলে তার স্বামী তাকে আবার আগের মতো ভালোবাসবে। কিছু বছর কেটে যাওয়ার পর হারকিউলিস এওলী (EOLI) নামের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েন। ডায়ানিরা সেটা বুঝতে পেরে মৃত্যুর আগে স্যান্টাউরের দেওয়া পোশাকটি তিনি হারকিউলিসকে দেন। আসলে এটি ছিলো স্যান্টাউরের একটি চাল। স্যান্টাউরের পোশাকটি ছিলো বিষাক্ত। ফলে পোশাকটি পড়ার সাথে সাথে হারকিউলিসের শরীরে প্রবল যন্ত্রণা শুরু হয় এবং তার শরীরে পোশাকের বিষের প্রভাবে তার মৃত্যু ঘটে।
হারকিউলিসের মৃত্যুর ফলে তার পিতা জিউস খুবই কষ্ট পান এবং দেবী এথেনা কে অনুরোধ করে বলেন হারকিউলিসকে যেনো পুনর্জীবিত করে মাউন্ট অলম্পসে নিয়ে আসা হয় এবং তাকে যেনো দেবতা বানিয়ে দেওয়া হয়। জিউসের কথা মতো দেবী এথেনা হারকিউলিসকে পুনর্জীবিত করে মাউন্ট অলম্পাসে (MOUNT OLYMPUS) নিয়ে আসেন এবং হারকিউলিসকে দেবতা বানিয়ে দেওয়া হয় এবং তাকে অমরত্ব প্রদান করা হয়। এভাবেই গ্রীক ও রোমান পুরাণ অনুযায়ী হারকিউলিস অমর হয়ে রয়েছেন।

Comments

Popular Posts