"সভ্যতার আঁতুড়ঘর - মেসোপটেমিয়া"

নদীর হাত ধরেই সৃষ্টি হয়েছে বহু মানব সভ্যতার। নদী বহুকাল ধরেই মাতৃস্নেহে লালনপালন করে গিয়েছে সেই সভ্যতাগুলিকে। কিন্তু বর্তমানে অবাধ্য সন্তানের মতোই সভ্য মানুষগুলো বর্জ্যের মাধ্যমে দূষিত করে চলেছে নদীর জল। তবুও স্নেহময়ীর মতোই নদী আজও সহ্য করে চলেছে সেই অবাধ্যতা এবং অকৃতজ্ঞতা। এই কারণেই বাংলা সহ বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে নদীকে "মা" বলে সম্মোধন করা হয়েছে।

এইরকমই একটি নদীমাতৃক সভ্যতা হলো মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। আজ থেকে প্রায় ৫৭০০ বছর আগে এই সভ্যতার সূচনা হলেও এই সভ্যতা সম্পর্কে জানার আগ্রহ মানুষের মধ্যে আজও আছে। মানব ইতিহাসে "প্রথম সভ্যতা" নামে পরিচিত এই সভ্যতা টাইগ্রীসইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে উঠেছিলো। ইরাকসহ সিরিয়া ও তুরস্কের উত্তরাংশ সাথে ইরানের খুজেস্থান প্রদেশের অঞ্চলগুলিই ছিলো মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অন্তর্গত। মেসোপটেমিয়া শব্দের অর্থ হলো দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থান বা ভূমি। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর মধ্যবর্তী স্থানে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো বলে গ্রীকরা এই সভ্যতার নাম দেয় মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম মেসোপটেমিয়া খ্রীস্টপূর্ব ৩৫০০ হতে খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের মধ্যেই সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটিয়েছিলো। খ্রীস্টপূর্ব ১৫০ সালের দিকে মেসোপটেমিয়া পার্সিয়ানদের দখলে থাকলেও পরে পার্সিয়ানদের সাথে রোমানদের যুদ্ধ হওয়ার পর রোমানরা এই অঞ্চলটি দখল করে নেয়। তবে রোমানরা এই অঞ্চল ২০০ বছরের বেশি শাসন করতে পারে নি। দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে পার্সিয়ানরা ফের এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করে। এরপর শুরু হয় মুসলিম শাসন আমল। মুসলিম শাসন আমলে এই অঞ্চল ইরাক নামে পরিচিতি লাভ করে।
কালক্রমে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর পলিমাটি পড়ে নদীর মধ্যবর্তী স্থানে উর্বর জমির সৃষ্টি হয়। প্রায় ৬০০০ খ্রীস্টপূর্ব থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে এসে সমবেত হতে শুরু করে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক এমনও ধারণা করেন যে আজ থেকে প্রায় ১৬০০০ বছর আগে থেকেই এখানে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিলো। নদী বেষ্টিত জমি এবং কোনো রকমের সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় মেসোপটেমিয়া বহুবারই বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এভাবেই পরবর্তীকালে কিছু সাম্রাজ্যের উন্মেষ ঘটে। মেসোপটেমিয়া উত্তরাংশের নাম ছিলো অ্যাসিরীয়, দক্ষিনাশের নাম ব্যবিলনীয়। ব্যবিলনের উত্তর অংশের নাম আক্কাদ ও দক্ষিণ অংশের নাম সুমের। এই আক্কাদ ও সুমেরের সৃজনশীলতার ফল হলো মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। মেসোপটেমীয় সভ্যতার পর্যায় ছিল মোট চারটি। যথা- সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, অ্যাসিরীয় এবং ক্যালডীয়।
পৃথিবীর আকার সম্পর্কে মেসোপটেমিয়ানদের বিশ্বাস ছিলো পৃথিবী গোল চাকতির মতো। মাটির নিচে নরক ও আকাশের উপরে স্বর্গ আছে। পৃথিবী জল দিয়ে তৈরি আর তাই জন্যই পৃথিবীর চারিপাশেই জল রয়েছে।

মেসোপটেমিয়ানরা বহুঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে সময়ের সাথে সাথে কিছু গোষ্ঠীর ধর্মমতও পরিবর্তন হয়েছিলো। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার দেবদেবীর মূর্তিপূজারও প্রমান পাওয়া যায়। ধর্মপালনের দিক থেকেও মেসোপটেমিয়ার মানুষরা অনেক অগ্রগামী এবং উন্নত চিন্তার অধিকারী ছিলো। বিভিন্ন উপাসনা স্থানে ধনী, দরিদ্র, দীনমজুর, কামার, কৃষক সব শ্রেণীর লোকেদের জন্য বসার ব্যবস্থা ছিলো। প্রত্যেকেই তাদের নিজের নিজের উপাস্য দেবদেবীর আরাধনা করতে পারতো। এতেই মেসোপটেমিয়ার সার্বজনীন ধর্মব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। সময়ের বিচারে মেসোপটেমিয়ার লোকেরা উন্নত গণিতবীদও ছিলো। উৎপাদিত ফসলের অংশ মন্দিরে জমা দেওয়ার রেওয়াজ ছিলো। কোন কৃষক কতটা ফসল মন্দিরে জমা দিলো সেটা মনে রাখতো মন্দিরের পুরোহিতরা। পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে তারা এই হিসাব করতো। ক্রমে এই হিসাব রাখার গুরুত্ব প্রাধান্য পেতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে মেসোপটেমিয়ান রা গণিতশাস্ত্রের উদ্ভাবন ও উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়। মেসোপটেমিয়ানদের গণিত ষাষ্ঠিক বা ৬০ কেন্দ্রিক ছিলো। এখান থেকেই এক ঘন্টায় ৬০ মিনিট ও এক মিনিটে ৬০ সেকেন্ড এর হিসাব আসে। এছাড়াও তারাই প্রথম বছরকে ১২ ভাগে বিভক্ত করে মাসের হিসাব প্রবর্তন করে এবং এক মাসকে ৩০ দিন হিসাবে ভাগ করে।
রাষ্ট্র, জনগণ ও মন্দিরের মধ্যে সম্পদ কিভাবে ভাগ করা হবে তা হিসাব করা হতো গণিতের মাধ্যমে। শাস্ত্রের বীজবপন ও অনুষ্ঠানের জন্য শুভদিনক্ষণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও পঞ্জিকার ব্যবহার করা হতো এবং এই পঞ্জিকা তৈরির জন্যও গণিতের ব্যবহার করা হতো। তাদের গণিতশাস্ত্রে পাটিগণিতের প্রাধান্য বেশি ছিলো। টাকা ও পণ্যদ্রব্য ব্যবহার বা আদানপ্রদানের জন্য পাটিগণিত ও বীজগণিতের ব্যবহার করা হতো। প্রথম দিকে মেসোপটেমিয়ানদের মনে পৃথিবী চ্যাপ্টা ও গোল চাকতির মতো এই ধারণা থাকলেও পরে তারাই প্রথমবারের মতো বুঝতে সক্ষম হয় যে পৃথিবী গোল। তারাই প্রথম পৃথিবীকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করার পরিকল্পনা করে। তারাই প্রথম ১২ টি রাশিচক্র ও জলঘড়ির আবিষ্কার করে।

মেসোপটেমিয়া সভ্যতার শুভ ও অশুভ দিনক্ষণ নির্ধারণ করার জন্য গ্রহ ও নক্ষত্র দেখার রীতি ছিলো। খালি চোখেই তারা এই কাজ করতো। তারাই প্রথম নক্ষত্র দেখে ১২ টি মাস নির্ধারণ করে এবং সপ্তাহে ৭ দিনের ধারণা আনে। ধাতুর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছিলো। খ্রীস্টপূর্ব ২০০ অব্দের আগেই তারা লোহা ও তামার ব্যবহার শুরু করেছিলো। এছাড়াও মন্দিরে ব্যবহৃত বাসনপত্র দেখেও বোঝা যায় তারাই প্রথম তামা ও টিন এর মিশ্রনে সংকর ধাতু ব্রোঞ্জ আবিষ্কার করেছিলো। মেসোপটেমিয়ানদের ভাষা কে সেমিটিক ভাষা বলা হতো। এই ভাষাতেই তারা দৈনিক ভাবের আদান-প্রদান, বিজ্ঞানচর্চা, ধর্মচর্চা, শাসনকার্য করতো।
মেসোপটেমিয়ানদের প্রধান কৃতিত্ব হলো ভাব আদান প্রদান করার জন্য প্রাচীন লেখন পদ্ধতির উদ্ভাবন। প্রথম দিকে এই ভাষা কিছু অর্থবোধক ছবির সাহায্যে প্রকাশ করা হতো। চিত্রধর্মী এই পদ্ধতিকে বিজ্ঞানীরা পিক্টোগ্রাফী বলে থাকেন। মেসোপটেমিয়ার লোকেরা প্রধানত কাদামাটির উপর নলখাগড়ার ছুঁচাল মাথা দিয়ে লিখে তা শুকিয়ে নিতো। সেই সময় লেখাগুলো শুধুমাত্র হিসাব সংরক্ষনের কাজে ব্যবহার করা হতো। আধুনিক দপ্তরীয় দলিলের ব্যবহার সুমেরীয়দের মধ্যে প্রথম লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্যের জন্য সুমেরীয়রা যে ভাষার ব্যবহার করতো তাকে বিজ্ঞানীরা হেমেটিক ভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন।
বিখ্যাত লেখক হোমার তাঁর ইলিয়াড ও ওডিসি লেখার প্রায় ১০০০ বছর পূর্বে সুমেরীয়রা তাদের নিজস্ব ভাষার সাহিত্য রচনা করেছিলো। এর নাম ছিলো গিলগামেস।
এইসব সাহিত্য থেকে জানা যায় এখানের লোকজন অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবন ছিলো।
ব্যবিলনীয় শাসন ব্যবস্থায় তাদের লেখালিখিতে পরলৌকিক চিন্তাভাবনার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রধানত এগুলো ছিলো ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্য চিন্তা। মেসোপটেমিয়াতেই প্রথম আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিলো। এইভাবেই মেসোপটেমিয়া সভ্যতার হাত ধরে ধীরে ধীরে আরো অনেক সভ্যতার জন্ম নেয়। এইভাবেই মেসোপটেমিয়া সভ্যতা তার কৃতিত্বের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় ঠিক যেনো নলখাগড়ার ছুঁচাল মাথা দিয়ে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করে দিয়েছে।

Comments

Popular Posts